পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- يَأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَ انْثَى وَجَعَلْنَكُمْ شُعُوْبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا ، إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَكُمْ ، إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ [উচ্চারণ: ইয়া আইয়্যুহান নাসু ইন্না খালাক্বনাকুম মিন যাকারিও ওয়া উনছা ওয়া জা'আলনাকুম শু'ঊবাও ওয়া ক্বাবাইলা লিতা'আরাফু, ইন্না আকরামাকুম 'ইনদাল্লাহি আতক্বাকুম, ইন্নাল্লাহা 'আলীমুন খাবীর ।] অর্থাৎ : "হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক থেকে, এবং তোমাদেরকে পরিণত করেছি বিভিন্ন জাতিতে ও বিভিন্ন গোত্রে, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহ্র কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদাবান সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মোত্তাকি। নিশ্চয় আল্লাহ্ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।" (সূরা-আল হুজুরাত-৪৯: আয়াত-১৩) মহান রাব্বুল আলামীনের এ বাণী মোবারকে বিষয়টি সুস্পষ্ট, মানুষ সামাজিক জীব। তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হবে, এবং একে অন্যের কল্যাণ সাধন ও উপকার করবে। এমনিভাবে তারা একটি শান্তির সমাজ বিনির্মাণ করবে। উপরন্তু মানুষ মাত্রই শান্তির প্রত্যাশী। অথচ আজকের দিনে সমাজের মানুষ অশান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। শান্তির অন্বেষায় মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু তারা অশান্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। এর মূল কারণ, আল্লাহ্ থেকে বিমুখ হওয়া এবং আল্লাহ্র দেয়া বিধান থেকে বিচ্যুত হওয়া। আল্লাহ্ বলেন- فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ ، وَقُلْ لِّلَّذِينَ اُوْتُوا الْكِتَبَ وَالْأُمِّيِّنَ وَ أَسْلَمْتُمْ . فَإِنْ أَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلْغُ ، وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ [উচ্চারণ : ফাকুল আসলামতু ওয়াজহিইয়া লিল্লাহি ওয়া মানিত্তাবা'আনি, ওয়া কুল লিল্লাযীনা উতুল কিতাবা ওয়াল উম্মিইয়্যীনা আআসলামতুম, ফাইন আসলামু ফাক্বাদিহতাদাও, ওয়া ইন তাওয়াল্লাও ফাইন্নামা 'আলাইকাল বালাগু, ওয়াল্লাহু বাসীরুম বিল'ইবাদ।] অর্থাৎ : “হে রাসুল (সাঃ)! আপনি বলে দিন- আমি তো আত্মসমর্পণ করেছি আল্লাহ্র কাছে, এবং আমাকে যারা অনুসরণ করে, তারাও। আর যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের, এবং নিরক্ষরদের বলুন- তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছে? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তবে অবশ্যই তারাও সরল-সঠিক পথ পাবে। কিন্তু যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনার দায়িত্ব কেবল তো শুধু পৌঁছে দেয়া। আর আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।" (সূরা-আলে ইমরান-৩: আয়াত-২০) বর্তমান সমাজের মানুষ ষড়রিপুর তাড়নায় আল্লাহ্ উপর আত্মসমর্পণের পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথকে উপেক্ষা করে, নিজেদের মনগড়া অসংখ্য মতবাদের সৃষ্টি করে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যাশা করছে। কিন্তু মানুষের এ প্রচেষ্টায় সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে আত্মকলহ, সংঘাত ও পারস্পরিক হানাহানির সৃষ্টি হচ্ছে। সুমহান আল্লাহ্ বলেন- أَفَغَيْرَ دِيْنِ اللَّهِ يَبْغُوْنَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَ كَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُوْنَ [উচ্চারণ : আফাগাইরা দীনিল্লাহি ইয়াবগুনা ওয়া লাহু আসলামা মান ফিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি ত্বাও'আও ওয়া কারহাও ওয়া ইলাইহি ইউরজা'ঊন।] অর্থাৎ : "তবে কি তারা আল্লাহ্র দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন অন্বেষণ করে? অথচ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, এবং তাঁরই দিকে তারা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা-আলে ইমরান-৩: আয়াত-৮৩) মহান আল্লাহ্ অন্য আয়াতে এরশাদ করেন- وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيْهَا وَيُهْلِكَ الْحَرْثَ وَالنَّسْلَ ، وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ [উচ্চারণ: ওয়া ইযা তাওয়াল্লা সা'আ ফিল আরদ্বি লিইউফসিদা ফীহা ওয়া ইউহলিকাল হারছা ওয়ান নাসলা, ওয়াল্লাহু লা ইউহিব্বুল ফাসাদ।] অর্থাৎ : "আর যখন সে ফিরে যায়, তখন সে চেষ্টা করে যেন পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, এবং শস্যক্ষেত্র ও জীব-জন্তুর বংশ বিনাশ করতে পারে। আল্লাহ্ অশান্তি পছন্দ করেন না।" (সূরা-আল বাকারাহ-২: আয়াত-২০৫) আসলে মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ জ্ঞানী মনে করার কারণে আল্লাহ্র উপর নির্ভরশীল না হয়ে, নিজের সীমিত বিচার-বুদ্ধির উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ার ফলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে চরিত্রহীনতা, এবং সামাজিক জীবনে পাপাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ নিজেদের প্রিয়াকর্মের ফলেই আল্লাহ্ প্রদত্ত স্বর্গীয় শান্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ)-এর সাহাবায়ে কেরাম সর্বাবস্থায় আল্লাহতে আত্মসমর্পিত থেকে, তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথে পরিচালিত হওয়ায়, তারা ব্যক্তি জীবনে, পরিবার জীবনে ও সমাজ জীবনে শান্তির অধিকারী হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- بَايَعْنَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَالْمَنْشَطِ وَالْمَكْرَهِ وَعَلَى آثَرَةٍ عَلَيْنَا [উচ্চারণ: বাইয়া'না রাসূলাল্লাহি (সাঃ) 'আলাস সাম'ই ওয়াত্ব ত্বা'আতি ফিল 'উসরি ওয়াল ইউসরি ওয়াল মানশাত্বি ওয়াল মাকরাহি ওয়া 'আলা আছারাতিন 'আলাইনা।] অর্থাৎ: "আমরা আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ)-এর কাছে মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করার, সুখে-দুঃখে, বালা-মুসিবতে, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক তথা সর্বাবস্থায় রাসুল (সাঃ)-এর আনুগত্য করার, এবং আমরা নিজেদের উপর অন্যদের প্রাধান্য দিতে বাইয়াত গ্রহণ করেছি।" (বোখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩০, হাদীস নং-১৮৬) আর আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পণের মূল কথা হলো- আল্লাহ্র নূরের রূপ বা আকার আছে, তিনি নিরাকার নন, তাঁর সৃষ্ট মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যখন যা করবে, সকল অবস্থায়ই আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আনুগত্য বজায় রেখে, তাঁর ইচ্ছা ও বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে, তাঁরই কাছে মন সঁপে দিয়ে উত্তম উদ্দেশ্যে কাজ করবে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যখন নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদকে পরিত্যাগ করে আল্লাহ্ মনোনীত মহামানব তথা নবী, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে, স্বরূপে বিদ্যমান আল্লাহ্র কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে, অর্থাৎ আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়, অতঃপর আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হয়, তখনই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।