ঈমান الایمان শব্দের অর্থ বিশ্বাস। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ্র প্রতি, অর্থাৎ তাঁর একত্ববাদের প্রতি অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করার নামই ঈমান। আল্লাহ্ বলেন-
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوْبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ ، اَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَتِ طُوبَى لَهُمْ وَحُسْنُ مَابِ
[উচ্চারণ : আল্লাযীনা আমানু ওয়া তাত্বমাইন্নু কুলুবুহুম বিযিকরিল্লাহি, আলা বিযিকরিল্লাহি তাত্বমাইনুল কুলুবু, আল্লাযীনা আমানু ওয়া 'আমিলুস সালিহাতি তুবা লাহুম ওয়া হুসনু মাআব ।]
অর্থাৎ: "তারা ঐ লোক, যারা ঈমান আনে এবং যাদের ক্বালব আল্লাহর জিকিরে প্রশান্ত হয়; জেনে রেখো, আল্লাহ্ জিকিরেই ক্বালব প্রশান্ত হয়। আর যারা ঈমান আনে, এবং নেক কাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ ও শুভ পরিণাম।" (সূরা-আর রা'দ-১৩: আয়াত-২৮ ও ২৯)
ঈমানের পরিচয় প্রসঙ্গে আমীরুল মু'মিনীন, শেরে খোদা হযরত আলী ইবনে আবু তালেব কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ) এরশাদ করেন-
الْإِيْمَانُ مَعْرِفَةٌ بِالْقَلْبِ وَإِقْرَارُ بِالنِّسَانِ وَعَمَلٌ بِالْأَرْكَانِ
[উচ্চারণ: আলঈমানু মা'রিফাতুন বিলক্বালবি ওয়া ইক্বরারুন বিললিসানি ওয়া 'আমালুন বিল আরকান।]
অর্থাৎ : "ঈমান হচ্ছে ক্বালবের মারেফাত জানা, তথা ক্বালবের ভেতরে আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করা, অতঃপর মৌখিক স্বীকৃতি ও কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।” (ইবনে মাজাহ, তাবারানী ও বায়হাকীর শু'আবুল ঈমানের সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর-২৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৮৩)
অনুরূপভাবে আমীরুল মু'মিনীন, শেরে খোদা হযরত আলী কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে আরো বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন-
إِنَّ الْإِيْمَانَ يَبْدُوْ لُمْظَةً بَيْضَاءَ فِي الْقَلْبِ، فَكُلَّمَا ازْدَادَ الْإِيْمَانُ عَظَمًا إِزْدَادَ ذَلِكَ الْبَيَاضُ، فَإِذَا اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانُ ابْيَضُ الْقَلْبُ كُلُّهُ
[উচ্চারণ: ইন্নাল ঈমানা ইয়াবদূ লুমজ্বাতান বাইদ্বাআ ফিল ক্বালবি, ফাকুল্লামাঝ দাদাল ঈমানু 'আজ্বামান ইঝদাদা যালিকাল বাইয়াদু, ফাইযাস তাকমালাল ঈমানু ইবইয়াদ্বদ্বাল জ্বালবু কুলুহু।]
অর্থাৎ : "নিশ্চয়ই ঈমান হচ্ছে ক্বালবের ভেতর শুভ্র আলোকোজ্জ্বল অবস্থা প্রকাশ পাওয়া। ক্বালবে যখন ঈমান বৃদ্ধি পায়, তখন ক্বালবের উজ্জ্বলতাও বৃদ্ধি পায়। আর ঈমান যখন পরিপূর্ণতা লাভ করে, তখন ক্বালবের উজ্জ্বলতাও পরিপূর্ণ হয়ে যায়।” (মুসনাদে ইমাম আলী-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮১)
ঈমানের তিনটি স্তর রয়েছে। যথা-
১। এলমূল একিন عِلْمُ الْيَقِيْنِ
২। আইনুল একিন عَيْنُ الْيَقِيْنِ
৩। হাকুকুল একিন ﴾حَقُّ الْيَقِيْنِ
কোন বিষয়ে কিতাব পাঠ করে বা লোক মুখে শুনে বিশ্বাস স্থাপন করাকে এলমুল একিন বলে। আল্লাহ্ বলেন-
كَلَّا لَوْ تَعْلَمُوْنَ عِلْمَ الْيَقِينِ
[উচ্চারণ: কাল্লা লাও তা'লামূনা 'ইলমাল ইয়াক্বীন।]
অর্থাৎ : "সাবধান! তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান (এলমুল একিন) থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন হতে না।" (সূরা-আত তাকাছুর-১০২: আয়াত-৫)
অপরদিকে কোন বিষয়ে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে বিশ্বাস স্থাপন করাকে আইনুল একিন বলে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন-
لَتَرَوُنَّ الْجَحِيمَ لَا ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِينِ
[উচ্চারণ: লাতারাউন্নাল জাহীমা, ছুম্মা লাতারাউন্নাহা 'আইনাল ইয়াক্বীন।]
অর্থাৎ: "তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই। আবার বলি, তোমরা তো এটি দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে (আইনুল একিনে)।" (সূরা-আত তাকাছুর-১০২: আয়াত-৬ ও ৭)
আর কোন বিষয়ে নিজের মধ্যে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অনুভব করে বিশ্বাস স্থাপন করাকে হাক্বকুল একিন বলা হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন-
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ
[উচ্চারণ: ওয়া'বুদ রাব্বাকা হাত্তা ইয়া'তিইয়াকাল ইয়াক্বীন ।]
অর্থাৎ : "হাকুকুল একিন অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো।" (সূরা-আল হিজর-১৫: আয়াত-৯৯)
মূলত হাক্বকুল একিনই প্রকৃত ঈমান। ঐ অবস্থায় ঈমান মানুষের মাঝে একটি নূর হিসেবে বিকাশ লাভ করে। ক্বালবের মধ্যে আল্লাহ্ জিকির চালু না হওয়া পর্যন্ত ঈমানের নূর সৃষ্টি হয় না। আর এটি তাওয়াজ্জোহ শক্তির মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
সুতরাং প্রেরিত মহামানব তথা নবী, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বলা হয়। আর ঈমানের এ প্রাথমিক স্তরকে এলমুল একিন বলে। অতঃপর ইবাদত-বন্দেগী ও সাধনা-রিয়াজতের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামীনের দীদার লাভ করে আইনুল একিনের স্তরে উপনীত হতে হয়, সর্বশেষে নিজের মাঝে আল্লাহ্ নূর বিকশিত করে আল্লাহ্র অস্তিত্ব উপলব্ধি করার নাম হাক্বকুল একিন। মহান রাব্বুল আলামীনের অপার দয়ায় হাক্বকুল একিনের স্তরে উপনীত হতে পারলে আর ঈমান হারা হওয়ার ভয় থাকে না। এটিই প্রকৃত ঈমান।