ইসলাম (الإسلام) শব্দ থেকে মুসলিম (المسلمُ) শব্দের উৎপত্তি। উভয় শব্দেরই মাদ্দাহ তথা শব্দমূল সিলমুন (سَلِمَ), যার অর্থ শান্তি। ইসলাম (الإسلام) শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, বশ্যতা স্বীকার করা, নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া।অন্যদিকে মুসলমান (المسلمُ) শব্দের অর্থ- আত্মসমর্পণকারী, বশ্যতা স্বীকারকারী, শান্তিতে বসবাসকারী।
মহান আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে শান্তি ও মুক্তির পথনির্দেশনা দেয়ার জন্য ইসলাম ধর্মের আদর্শ শিক্ষা দিতে গিয়ে নির্দেশ করেন -‘আসলিম (أسليم) অর্থাৎ: ‘আত্মসমর্পণ করুন’। জবাবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বলেন-
“আসলামতু লিরাব্বিল আ’লামিন (أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ)
অর্থাৎ "আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম”। (সূরা-আল বাকারাহ-২: আয়াত-১৩১)
এমনিতেই মহান আল্লাহ সকল নবী ও রাসূলের ইমাম, রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-কে নির্দেশ করেন—
قُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ ۗ وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ ۚ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا
[উচ্চারণ: ফাক্বুল আসলামতু ওয়াজহিহিয়া লিল্লাহি ওয়া মানিত্তাবা’আনি, ওয়া ক্বুল লিল্লাযীনা ঊতুল কিতাবা ওয়াল উম্মিইয়্যীনা আসলামতুম, ফাইন আসলামূ ফাক্বাদিহ তাদাও।]
অর্থাৎ: “আপনি বলে দিন- আমি তো আত্মসমর্পণ করেছি আল্লাহর কাছে, এবং আমাকে যারা অনুসরণ করে, তারাও। আর যাদের কিতাব দেয়া রয়েছে, তাদের, এবং নিরক্ষরদের বলুন- তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তবে অবশ্যই তারাও সরল- সঠিক পথ পাবে।” (সূরা-আলে ইমরান-৩: আয়াত-২০)
প্রকৃতপক্ষে যে জীবন ব্যবস্থায় মানুষ স্রষ্টার উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, এবং তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হয়ে সৃষ্টিকে পূর্ণ শান্তিতে বসবাসের সুযোগ করে দেয়, এটিই ইসলাম। যে ব্যক্তি ইসলামকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করে পূর্ণ শান্তির অধিকারী হয়েছেন, এবং জন্যও এত বড় আসতেছে নাকি শান্তির কারণ হয়েছেন, তিনি প্রকৃত মুসলমান।
এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ্ বলেন-
( اَسۡلَمَ وَجۡهَهٗ لِلّٰهِ وَ هُوَ مُحۡسِنٌ فَلهٗۤ اَجۡرُهٗ عِنۡدَ رَبِّهٖ ۪ وَ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ)
[ উচ্চারণ : মান আসলামা ওয়াজহাহূ লিল্লাহি ওয়া হুওয়া মহসিনুন ফালাহূ আজরুহূ ইনদা রাব্বিহী, ওয়ালা খাওফুন ‘ আলাইহিম ওয়ালা হুম ইয়াহঝানূন।]
অর্থাৎ : “ যে কেউ নিজেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে, এবং সে সৎকর্ম পরায়ণও, তার জন্য রয়েছে তার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার। তাদের কোন ভয় নেই, এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” ( সূরা আল বাকারাহ-২: আয়াত -১১২)
এমনিভাবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা:) এরশাদ করেন -
الْمُسْلِمَ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
[উচ্চারণ : আলমুসলিমু মান সালিমাল মুসলিমূনা মিল লিসানিহী ওয়া ইয়াদিহী।]
অর্থাৎ : “মুসলমান সেই ব্যক্তি ও হাত থেকে অপর মুসলমানগণ ( তথা অন্য মানুষেরা) নিরাপদ থাকে। ” ( বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা - ১২)
যিনি মুসলমান দাবি করেন, অথচ পূর্ণ শান্তি লাভ করেন না, বুঝতে হবে স্রষ্টার উপর আত্মসমর্পণ ও তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হওয়ার মধ্যে ঐ ব্যক্তির ত্রুটি রয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হওয়ার জন্য যে তিনটি বিষয় অর্জন করতে হবে তা হলো -
১। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
২। নিজের ভেতরে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে হবে।
৩। তাঁর নির্দেশে নিজেকে পরিচালিত করতে হবে।
আর গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি পরম করুণাময় আল্লাহ্ তাঁর পাক জবানেই বলে দিয়েছেন, এরশাদ হচ্ছে -
( وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِكُمۡ ؕ اَفَلَا تُبۡصِرُوۡنَ ﴿
[ উচ্চারণ :ওয়া ফী আনফুসিকুম, আফালা তফসিরূন। ]
“অর্থাৎ : আমি তোমাদের ক্বালবের (সপ্তম স্তর) নাফসির মোকামে বিরাজ করি, তোমরা কি দেখো না?” ( সূরা আয যারিয়াত -৫১: আয়াত- ২১)
সাধারণত আমরা যারা মুসলমান বলে নিজেদেরকে দাবী করি, তাদের ধারণা- মুসলমান পিতা-মাতার ঘরে জন্মলাভ করেছি বলে অবশ্যই আমরা মুসলমান। আসলে এটি ভ্রান্ত ধারণা। কেননা ইসলাম একটি আদর্শের নাম, এবং মুসলমান ঐ আদর্শ নিজ চরিত্রে বাস্তবায়নকারীর নাম। ইসলামের আদর্শ সাধনার মাধ্যমে নিজ চরিত্রে বাস্তবায়ন করতে হয়, এটি উত্তরাধিকারীসূত্রে অর্জন করা যায় না, যেমন ডাক্তারের ছেলে ডাক্তারি বিদ্যা শিক্ষা না করে জন্মসূত্রে ডাক্তার হতে পারে না।
এজন্য মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ ( আ:), এবং হযরত ইয়াকুব (আ:) স্ব স্ব পুত্রদেরকে সাধনার মাধ্যমে প্রকৃত মুসলমান হওয়ার যেমন নির্দেশনা দিয়েছেন, তেমনি আল্লাহ্তে পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন -
وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبۡرٰهٖمُ بَنِیۡهِ وَ) یَعۡقُوۡبُ ؕ یٰبَنِیَّ اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰی لَكُمُ الدِّیۡنَ فَلَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ)
[ উচ্চারণ : ওয়া ওয়াসসা বিহা ইবরাহিমু বানীহি ওয়া ইয়া’ক্বুবু, ইয়াবানিইয়্যা ইন্নাল্লাহাস ত্বাফা লাকুমুদ দিনা ফালা তামূতুন্না ইল্লা ওয়া আনতুম মুসলিমূন।]
অর্থাৎ : “ আর এরই অসিয়ত করেছেন ইব্রাহিম (আ:) তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুব (আঃ)ও - হে পুত্রগণ! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনিত করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না।” ( সূরা আল বাকারাহ-২ : আয়াত- ১৩২)
হযরত রাসূল (সা:) ইসলামের জামানায় একজন মানুষ কাফিরের ঘরে জন্ম নিয়ে, যে পদ্ধতিতে চরিত্র সংশোধন করে রাসূল (সা:) - এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মুসলমান হতে পেরেছে, বর্তমানে অনুরূপভাবে মুসলমান পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নিয়েও হযরত রাসুল (সঃ) - এর উত্তরসূরী মহামানব তথা যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আউলিয়ায়ে কেরামের সান্নিধ্যে গিয়ে যথাযথ আদর্শ অনুসরণ করে নিজেকে প্রকৃত মুসলমানে পরিণত করতে হবে।